ঋণের পরিকল্পনা করছে পিডিবি

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: চলতি বছরের তিন মাসে তিন দফা বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। শিগগির আরেক দফা দাম বাড়তে পারে। এরপরও লোকসানে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। অর্থ সংকটে বেসরকারি ও আমদানি করা বিদ্যুতের দাম নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না সংস্থাটি। এখন ঋণ করে বিল ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার পরিকল্পনা করছে পিডিবি। এ জন্য দীর্ঘ বা মধ্য মেয়াদে ঋণের বিষয়ে সরকারের অনুমোদন চেয়েছে সংস্থাটি।

সূত্র বলছে, প্রস্তাবিত ঋণের অনুমোদন পেলে পিডিবির ব্যয় আরও বাড়বে। কারণ এই ঋণের সুদ হবে অনেক বেশি। ফলে পিডিবিকে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই সেই বর্ধিত ব্যয় সমন্বয় করতে হবে। জনগণের ওপর চাপ আরও বাড়বে।

গত ২৮ মার্চ বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে পিডিবি জানিয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোয় ডলার সংকট থাকায় বিদ্যুৎ আমদানির বিল পরিশোধ বিলম্বিত হচ্ছে। এতে একদিকে পিডিবির ওপর সারচার্জ আরোপ হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া পড়েছে কয়েক মাস। কেন্দ্র মালিকরা আমদানি করা কয়লা ও ফার্নেস অয়েলের মূল্য পরিশোধ করতে পারছেন না। খুচরা যন্ত্রাংশ এবং লুবঅয়েল কেনাও সম্ভব হচ্ছে না। এই সংকট কাটাতে আবার ঋণ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছে পিডিবি।

চিঠিতে পিডিবি ঋণ গ্রহণের বিষয়ে দুটি পৃথক প্রস্তাব দিয়েছে। প্রথমত ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিল পরিশোধে বিদেশি ব্যাংক থেকে ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ হিসেবে গ্রহণ করা। দ্বিতীয়ত ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া এবং এক্সপোর্ট ক্রেডিটের অপরিশোধিত ১০৩ কোটি ডলারের ঋণের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদে পুনঃঋণ গ্রহণ করা।

পিডিবি বলছে, অর্থবিভাগের সম্মতি পেলে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সুদের হার, অন্যান্য চার্জ এবং শর্তাবলি চূড়ান্ত করা হবে।

আদানির বিদ্যুতে বাড়ছে আমদানি ব্যয়

ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছিল। গত ০৯ মার্চ থেকে আদানির গড্ডা কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পরীক্ষামূলক ভাবে আমদানি শুরু হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন ৭৫০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ আসছে। জুনের পর এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট আসবে।

পিডিবির তথ্য বলছে, আদানি ছাড়াই ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাতের এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে বছরে গড়ে ব্যয় হয় প্রায় ৬৬ কোটি ডলার। আদানির এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির খরচ হবে বছরে ১১৪ দশমিক ৩৯ কোটি মার্কিন ডলার। আদানির বিদ্যুতের দাম বেশি হওয়ায় বিদ্যুৎ আমদানিতে পিডিবির খরচ বেড়ে যাবে। চিঠিতে পিডিবি আদানির প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম ধরছে ১৬২ ডলার। 

এদিকে, রোববার আদানি গ্রুপের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে, বর্তমান মূল্যে প্রতি টন কয়লার দাম পড়বে ১৩৯ ডলার।

বিল ও কিস্তি বকেয়া

৮ প্রকল্পে ১৭০ কোটি ডলার ঋণ করেছে পিডিবি। এই ঋণের বিপরীতে বছরে ১৪ দশমিক ৬ কোটি ডলার কিস্তি দিতে হচ্ছে। ডলার সংকটে প্রায়ই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। এখন পর্যন্ত এই ঋণের ১০৩ দশমিক ৬ কোটি ডলার বকেয়া রয়েছে। 

এদিকে, অর্থ সংকটে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর বিলও বকেয়া রয়েছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে বেসরকারি বিদ্যুতের মালিকরা পিডিবির কাছে ২৮ হাজার ১৭০ কোটি টাকা পাবে।

বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়, মিলছে না ভর্তুকি

২০২০-২১ সালের বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ছিল প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট-ঘণ্টা) ছয় টাকা ৬৪ পয়সা। ২০২১-২২ সালে তা বেড়ে হয় নয় টাকা ৪৪ পয়সা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে পিডিবির খরচ হচ্ছে ১২ টাকা ০৩ পয়সা।

এ বিষয়ে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘ভুল পরিকল্পনায় অযাচিত ভাবে একের পর এক ব্যয়বহুল প্রকল্প বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিযোগিতা ছাড়াই ব্যয়বহুল রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন, দলীয় লোকদের ব্যবসা দিতে চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং বসিয়ে বসিয়ে এগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করার কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। গত এক যুগে বেসরকারি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে নিয়েছেন।’

উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় লোকসান বাড়ছে পিডিবির। এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ১২ টাকা ০৩ পয়সা, পাইকারি বিক্রয় মূল্য ছয় টাকা ৭০ টাকা। প্রতি ইউনিটে পিডিবির লোকসান পাঁচ টাকা ৩৩ পয়সা। সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিয়ে পিডিবি এই ঘাটতি মেটায়। অর্থ সংকটে সরকারের কাছ থেকে সময়মতো ভর্তুকি পাচ্ছে না পিডিবি। গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৭ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ভর্তুকি চেয়েছে পিডিবি।

বিদ্যুতের দাম বাড়ছেই

অর্থ সংকটে যেমন ভর্তুকির টাকা দিতে পারছে না সরকার। অন্যদিকে আইএমএফের ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে এই ঘাটতি সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই প্রতিবারে পাঁচ শতাংশ করে তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ঈদের পর আরেক দফায় পাঁচ শতাংশ দাম বাড়তে পারে।